একজন শ্রমিক/কর্মচারীর চাকুরী বিভিন্ন ভাবে যেমন ছাটাই, ডিসচার্জ, অপসারণ, বরখাস্ত, অবসর, পদত্যাগ ইত্যাদি নানাবিধ কারনে অবসান হইতে পারে । যে কারনেই অবসান হোক না কেন, শ্রম আইন অনুসারে আপনি কিছু না কিছু সুবিধা অবশ্যই পাবেন । কি কি সুবিধা পাবেন তা অনেকটা নির্ভর করছে আপনি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে কত সময় কাজ করেছেন, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান ফান্ড সমূহ, চাকুরীর অবসানের ধরন ইত্যাদির উপর ।আপনার ধারনা না থাকলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই হয়ত আপনাকে আপনার প্রাপ্য সব পাওনাদি পরিশোধ করে দেবে । তবে ব্যাতিক্রম যে নেই তা বলা যাবেনা । তাছাড়া আপনার এ বিষয়ে জ্ঞান থাকলে হিসেব করতে ও সঠিক পাওনা বুঝে নেয়া আপনার জন্য সহজ হবে।
আপনার চাকুরীর অবসান যেভাবেই হোক, চলুন প্রথমে দেখে নেই কি কি সুবিধা সবার জন্য প্রযোজ্য । ব্যাতিক্রমগুলো সংশ্লিষ্ট প্যারায় বলা আছে । এখানে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, আপনি একজন স্থায়ী শ্রমিক এবং শ্রম আইন আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
বকেয়া বেতন ও নোটিশ পিরিয়ড এর পাওনা
আপনার যদি কোন বেতন বা ওভারটাইম এর বকেয়া থাকে তা আপনি অবশ্যই পাবেন। একই সাথে যদি আপনাকে চাকুরিচ্যুত করার জন্য আইনে নির্ধারিত সময়ের নোটিশ না দিয়ে থাকে, তাহলে উক্ত সময়ের নোটিশের পরিবর্তে কোম্পানি আপনাকে বেতন/মজুরী পরিশোধ করবে।
প্রভিডেন্ট ফান্ড এর পাওনা
আপনার চাকুরীর অবসান যেভাবেই হোকনা কেন, আপনার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আপনাকে আপনার প্রভিডেন্ট ফান্ড এর পাওনা চাকুরী অবসানকালীন পরিশোধ করিবে । তবে তার জন্য কোম্পানিতে অবশ্যই প্রভিডেন্ট ফান্ড থাকতে হবে, যাতে আপনি অংশগ্রহন করেছেন অর্থাৎ আপনার বেতন থেকে উক্ত ফান্ডের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা কেটে নেয়া হয়েছে । প্রভিডেন্ট ফান্ড না থাকলে, এ বাবদ আপনি কোন টাকা পাবেননা।
গ্রাচুয়িটি
শ্রম আইনের ২ (১০) ধারা মতে কোন শ্রমিকের প্রতি পূর্ণ বৎসর চাকুরী অথবা ছয় মাসের অতিরিক্ত সময়ের চাকুরীর জন্য তাহার সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরী হারে ন্যূনতম ৩০ দিনের মজুরী অথবা ১০ বৎসরের অধিককাল চাকুরীর ক্ষেত্রে তাহার সর্বশেষ প্রাপ্ত মজুরী হারে ৪৫ দিনের মজুরী গ্রাচুইটি হিসেবে উক্ত শ্রমিককে তাহার চাকুরীর অবসানে প্রদেয় । উপরোক্ত ধারা পড়লে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, প্রত্যেক নিয়োগকারীই তাহা দিতে বাধ্য । কিন্তু উক্ত আইনের পরবর্তী কয়েকটি ধারা পড়লে যা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে যদি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে গ্রাচুয়িটি ফান্ড থাকে শুধুমাত্র তখনই একজন শ্রমিক বা চাকুরীজীবী তাহা পাবেন ।
ক্ষতিপূরণ
হয়ত আপনার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্রাচুয়িটি এর কোনটিই নেই । তাহলে কি কিছুই পাবেননা? হতাশ হওয়ার কিছু নেই । আপনার জন্য আছে ক্ষতিপূরণ (compensation) যাকে অনেকেই সার্ভিস বেনিফিট বলে জানেন । এবার দেখা যাক, কত টাকা পাবেন। এক্ষত্রে চাকুরীর বয়স, অবসানের ধরনএর উপর ভিত্তি করে কিছুটা ভিন্নতা আছে।
১। পদত্যাগ
চাকুরীর বয়স ৫ বছরের কম হলে, আপনি ক্ষতিপূরন পাবেন না।
চাকুরীর বয়স ৫ বছর থেকে ১০ বছরের মধ্যে হলে প্রতি বছরের চাকুরীর জন্য ১৪ দিনের বেতন/মজুরী ।
যদি ১০ বছর বা তার অধিক চাকুরী করে থাকেন তাহলে প্রতি বছরের চাকুরীর জন্য ৩০ দিনের বেতনের সমপরিমান টাকা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান আপনাকে ক্ষতিপূরন হিসেবে দেবে।
২। ছাটাই ও ডিসচার্জ
আপনি যদি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে অবিচ্ছিন্নভাবে প্রতিষ্ঠানে ১ বছর কাজ করে থাকেন এবং আপনাকে যদি ছাটাই বা ডিসচার্জ করা হয়, তাহলে আপনি প্রতি বছরের কাজের জন্য ৩০ দিনের মজুরীর সমপরিমান টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন।
৩। অপসারন বা বরখাস্ত
আপনাকে যদি চাকুরী হইতে অপসারন কিংবা বরখাস্ত করা হয় এবং যদি আপনার অবিচ্ছিন্ন চাকুরীর মেয়াদ অন্যুন এক বৎসর হয়, মালিক ক্ষতিপূরণ বাবদ আপনাকে প্রত্যেক সম্পুর্ণ চাকুরী বছরের জন্য ১৫ দিনের মজুরী প্রদান করিবেন। উল্লেখ্য যে মালিকের ব্যবসা বা সম্পত্তি সম্পর্কে চুরি, আত্মসাৎ,প্রতারণা বা অসাধুতা কিংবা প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃংখলতা, দাংগা-হাংগামা, অগ্নিসংযোগ বা ভাংচুর এর অভিযোগে আপনাকে বরখাস্ত করা হইলে আপনি উপরে বর্নীত ক্ষতিপূরন প্রাপ্ত হইবেন না ।
৪। মালিক কর্তৃক অব্যাহতি বা অবসর
যদি বরখাস্ত, অবসারন, ছাটাই, ডিসচার্জ ইত্যাদি ছাড়া বা কোন কারন ছাড়াই অন্য কোনভাবে কোম্পানি আপনাকে অব্যাহতি দিতে চায়, অথবা আপনি অবসরে যান সেক্ষেত্রে আপনাকে প্রত্যেক সম্পূর্ণ বছরের চাকুরীর জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে ত্রিশ দিনের মজুরী প্রদান করিবেন।
৫।মৃত্যু
দুই বছরের অধিককাল চাকুরীরত থাকা অবস্থায় কেউ মৃত্যুবরণ করলে, মৃত ব্যাক্তির মনোনীত ব্যক্তি বা মনোনীত ব্যক্তির অবর্তমানে তাহার কোন পোষ্যকে তাহার প্রত্যেক পূর্ণ বছর বা উহার ০৬ (ছয়) মাসের অধিক সময় চাকুরীর জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৩০(ত্রিশ) দিনের এবং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় অথবা কর্মকালীন দুর্ঘটনার কারণে পরবর্তীতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মজুরী প্রদান করিবেন। এই অর্থ মৃত শ্রমিক চাকুরী হইতে অবসর গ্রহণ করিলে যে অবসর জনিত সুবিধা প্রাপ্ত হইতেন, তাহার অতিরিক্ত হিসাবে প্রদেয় হইবে।
উল্লেখ্য যে, যদি আপনার নিয়োকারী প্রতিষ্ঠানে গ্রাচুয়িটি ফান্ড থাকে, তাহলে আপনি ক্ষতিপূরণ ও গ্রাচুয়িটির মধ্যে যে কোন একটা প্রাপ্ত হইবেন । এক্ষেত্রে দুটির মধ্যে পাওনার পরিমান যেটি বেশি হয়, আপনি তা প্রাপ্ত হইবেন ।
অংশগ্রহন তহবীল এর পাওনা
শ্রম আইনের ধারা ২৩২ ও ২৩৪ ধারা অনুযায়ী যদি কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানেরকোন হিসাব বছরের শেষ দিনে উহার পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ অন্যূন এক কোটি টাকা অথবা কোন হিসাব বছরের শেষ দিনে উহার স্থায়ী সম্পদের মূল্য অন্যূন দুই কোটি টাকা হয়, তাহলে উক্ত কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান প্রত্যেক বৎসর শেষ হইবার অন্যূন নয় মাসের মধ্যে, পূর্ববর্তী বৎসরের নীট মুনাফার পাঁচ শতাংশ (৫%) অর্থ ৮০:১০:১০ অনুপাতে যথাক্রমে অংশগ্রহণ তহবিল, কল্যাণ তহবিল এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে প্রদান করিবে । সকল সুবিধাভোগী এই অধ্যায়ের অধীন সকল সুবিধা সমান অনুপাতে পাইবার এবং তহবিলদ্বয়ে অংশগ্রহণের যোগ্য হইবেন ৷ কোন হিসাব বছরে কোন সুবিধাভোগী কোন কোম্পানীতে অন্যুন ছয় মাস চাকুরী পূর্ণ না করিলে তিনি উক্ত বছরের জন্য তহবিলে অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন না৷ অংশগ্রহন তহবীল এর একটা নির্দিষ্ট অংশ প্রতি পছর শ্রমিকদের মাঝে বণ্টন করতে হবে, এবং বাকি টাকা চাকুরী হইতে অবসান এর সময় শ্রমিককে প্রদান করতে হবে ।
উল্লেখ্য যে, বরখাস্তজনীত কারনে কারো চাকুরী হইতে অবসান হইলে তিনি, অবসানের সময় উক্ত টাকা প্রাপ্ত হইবেন না ।
অর্জিত ছুটি
ধারা ১১৭ এর অধীন আপনি প্রতিষ্ঠানে অবিচ্ছিন্নভাবে এক বৎসর চাকুরী পূর্ণ করিয়া থাকলে পরবর্তী বারো মাস সময়ে তাহার পূর্ববর্তী বারো মাসের কাজের জন্য (i) কোন দোকান বা বাণিজ্য বা শিল্প প্রতিষ্ঠান অথবা কোন কারখানা অথবা সড়ক পরিবহন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, প্রতি আঠার দিন কাজের জন্য একদিন, (ii) কোন চা বাগানের ক্ষেত্রে, প্রতি বাইশ দিন কাজের জন্য একদিন; (iii)কোন সংবাদপত্র শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রতি এগার দিন কাজের জন্য একদিন হারে গণনার ভিত্তিতে ছুটি মঞ্জুর করিতে হইবে । কোন প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিকের এই উক্ত ছুটি পাওনা বন্ধ হইয়া যাইবে যখন তাহার পাওনা অর্জিত ছুটি- (ক) কোন কারখানা অথবা সড়ক পরিবহন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, চল্লিশ দিন হয়; (খ) কোন চা-বাগান, দোকান বা বাণিজ্য অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, ষাট দিন হয়। কিশোর শ্রমিকদের ক্ষেত্রে হিসেবটা ভিন্ন । এছাড়াও যদি কোন শ্রমিক ছুটির জন্য দরখাস্ত করার পর তা মালিক মঞ্জুর না করেন, তাহলে উক্ত ছুটি উপরোক্ত ষাট বা চল্লিশ দিনের অধিক হইলেও যোগ হইবে ।
আমি চেষ্টা করেছি প্রয়োজনীয় সব বিষয়সমুহ সাধারনের বোঝার সুবিধার জন্য সরলভাবে উপস্থাপন করতে। ভুল-ভ্রান্তি, অস্পষ্টতা কিংবা কোন কিছু বাদ পরে গেলে, কমেন্টে কিংবা ম্যাসেজে জানাতে ভুলবেননা ।